তুমি ফিরে আসবে— আমি জানতাম। বুকের গভীরে। দৃঢ় প্রত্যয় ছিলো এই যে, তুমি কোনোদিন আমার এ বুক ছেড়ে থাকতে পারবে না। হ্যাঁ, আমার বিশ্বাস বিফলে যায়নি— তুমি ফিরে এসেছো। আজ আমার হাসির দিন, আজ আমার কান্নার দিন। তাই এ্যামোন গগনবিদারী হাসি দিয়ে স্তব্ধ করে দিচ্ছি চারপাশের লোকালয়। আমার এ বাজখাঁই গলার হাসিতে আতঙ্কিত হয়ে যাচ্ছে সমস্ত চরাচর। ক্ষণে ক্ষণে সে হাসির আলোকচ্ছটায় রাত্রের ঘন আধার কেটে ঝলমলে উঠছে চারপাশের প্রকৃতি ক্ষণিকের জন্য।
অথচ কি অদ্ভুত, দ্যাখো! তুমি ফিরে এসেছো। এখন তো শুধু আমার আনন্দ হবার কথা। কিন্তু থেকে থেকেই ক্যানো য্যানো বিরহযমুনা উথলে উঠেছে। দুচোখ গড়িয়ে কান্না আসছে অঝোর ধারায়। সে কান্না থামবার নয়। বিরহ-চৈত্রের খরতাপে হৃদয়জমিনে যে ফাটল ধরেছে, সেসব এখন অথৈ জলের অতলে। আমার এই অশ্রুস্রোতে ভেসে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ বুকের জমিন। বুকের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী-হাওর, খাল-বিল, ডোবা-পুকুর এবং সুনীল জলধিতে এখন শুধু জলের খেলা আর জলের খেলা।। তবু আমার কান্না থামতেই চায়না। আমি শুধু ভাবি, এ্যাতো প্রেম অন্তরে লুকিয়ে রেখে, কী করে তুমি আমায় ছেড়ে এ্যাতোদিন ছিলে!
বিরহের এই দীর্ঘ-অবসানে যেখানে তোমার আনন্দিত হওয়ার কথা, বর্ষা, সেখানে তোমার মুখটা এখনো গোমড়া। চোখ দুটো ভারি। জলছলোছলো। জোড়া চোখের দিকে তাকালে, যে কেউ সহজেই বুঝে ফেলবে, হয়তো আবেগের খানিকটা ছোঁয়া কিংবা হাওয়ার একটু অনুভূতির সামান্য আন্দোলনেই তোমার চোখ থেকে অঝোর ধারায় ঝরে পড়বে অপরিমের জল।
বর্ষা, তুমি আমার নাড়ী-নক্ষত্র সবই তো জানো। জানো, আমি বাইরে যতোটা কঠিন হৃদয়ের, অন্তরে ঠিক তার বিপরীত। আমাকে তুমি তুলনা করতে বেলের সাথে। হ্যাঁ, তুমি অনেকটাই সত্য বলেছিলে। এই যে তুমি চলে গিয়েছিলে! সে দিনগুলো কি আমার ভালো গিয়েছে, বলো? নিশ্চয়ই দিনগুলো আমার ভালো যায়নি। লোকোমুখে কুশলাদি জেনেছো, পাড়াপড়শিদের কাছে খবর নিয়েছো। এবং, আমি যদি ভুল না করি, তাদের কাছ থেকে একটা উত্তরই শুনেছো— “কই, সবই তো ঠিকঠাক আছে দেখি! তার দৈনন্দিন আচার-আচরণে তো কোনো ব্যতিক্রম দেখছি না। লোকসমাজে নিত্য আনাগোনা, দৈনন্দিন সম্পর্ক, চলাফেরা, ওঠাবসা…।”
হ্যাঁ, সবকিছুই ঠিক ছিলো। অথচ তোমার বিরহে ভেতরে ভেতরে আমি কী নিদারুণ দুঃখবোধে ধুঁকে ধুঁকে মরছিলাম, সে হয়তো অন্তর্যামী ছাড়া কেউ জানেননা। আমি জানি, তুমি এসব জানতে, বর্ষা, আঁচ করতে পারতে। আমি শুধু আজো জানতে পারলাম না কোন্ অব্যক্ত অভিমানে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে। কোনোদিন জানতে চাইনি। প্রশ্ন করিনি ইচ্ছে করেই। অনেকবারই ইচ্ছে জেগেছে, চিঠি লিখি, জানতে চাই। কিন্তু ওই যে বললাম— বুকে একটা দৃঢ় প্রত্যয় ছিলো, তুমি যদি আমার হও, আমার বুকে ফিরে আসবেই, আসবে। ভুল তোমার ভাঙবে—
এতে কোনো ব্যতিক্রম হবে না।
বর্ষা! একি! তুমি আবার কাঁদতে শুরু করলে ক্যানো! এই দ্যাখো, তোমাকে দেখতে আশেপাশে কতো লোক জমে গ্যাছে। এসেছে শাপলা-শালুক, পদ্মের পাপড়িরা; ডগোমগো করছে আনন্দে! কদম-কেয়া আর জবা আমাদের কাণ্ড দেখে, মুখ টিপে টিপে ক্যামোন দুষ্টুমির হাসি হাসছে, দ্যাখো!
বর্ষা, চেয়ে দ্যাখো, তোমাকে অভিনন্দন জানাতে কদম, কলমি, বেলী আর গন্ধরাজ সুগন্ধি নিয়ে হাজির হয়েছে।
দোহাই বর্ষা, এভাবে আর কাঁদে না। আমার চোখের জলেই তো সমস্ত ভিটেমাটি, লোকালয় একাকার! বানভাসি হয়ে পড়েছে মাটির মায়ায় বসবাসরত জনগণ। মরানদী ভরে গিয়ে খরস্রোতে বইছে পাহাড়িঢল, প্রলয়-ভাঙন ধরিয়েছে পদ্মা মেঘনার দুই কূলে। তার উপর, যদি আবার তুমি কাঁদতে শুরু করো, তাহলে বঙ্গবাসীর দুর্দশার কি আর অবধি থাকবে?
এ্যাই বর্ষা, মুখ তুলে তাকাও। দ্যাখো! কী এলাহিকাণ্ড! মনে হচ্ছে য্যানো গ্রামের প্রতিটি বাড়ি জলের উপর দ্বীপের মতো ভাসছে।
এ্যাই ছাড় তো! হাঁসগুলোর কথায় কান দিয়ো না। ওরা তো গ্রাম্য! অশিক্ষিত, বাচাল। তোমার চেহারা গোমড়া— তাতে কি হয়েছে! আমি তো তোমার গোমড়া চেহারাটার প্রেমেই পড়েছি। পৃথিবীর সবাইকে দাঁত কেলিয়ে হাসতে হবে ক্যানো! তাহলে আমি রূপের এই বৈচিত্র্য কোথায় পাবো!
এইবার তো বুক থেকে মুখটা তোলো! তোমার জন্য কিন্তু এর চেয়ে লক্ষ-কোটিগুণ একটা সারপ্রাইজ রয়েছে। তুমি শুনলে যে তাতে কতোটুকু খুশি হবে, সেটা আমার নিজেরও কল্পনাতীত। এইতো সুবোধ মেয়ের মতো মুখ তুলে তাকিয়েছো। নিশ্চয়ই তুমি জানতে যে, তুমি চলে যাবার পর, এক বুক অভিমান আর অব্যক্ত ব্যথা বুকে চেপে বৃষ্টিও চলে গিয়েছিল মরুর দেশে। আজ তুমি ফিরে এসেছো, সেও ফিরে এসেছে। আরে! এভাবে ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে তাকাবার কী আছে! সত্যি বলছি তো! বললাম না, তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে! এইতো আমার চিরচেনা বর্ষা।
উহ! ওভাবে হেসো না তো! ও হাসির আলোর ঝলক আমি সইতে পারি না। বুকের আকাশের কালো মেঘ চিড়ে একেবারে এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যায়। চেয়ে দ্যাখো, তোমাকে দেখতে আসা লোকজন সবাই তোমার হাসিতে ক্যামোন বজ্রাহত হয়ে পড়েছে।
আহা বর্ষা! এখন আর ফিসফিসিয়ে বলার কিছু নেই। হ্যাঁ হ্যাঁ! তুমি ফিরে আসবার কিছুক্ষণ আগেই এসেছে বৃষ্টি। তোমার আগমন দেখে আমি তো আরো ভেবেছিলাম— তুমিই হয়তো পত্র মারফত বৃষ্টিকে জানিয়েছো কিংবা আসতে বলেছো।
দেবো দেবো! তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আমি একে একে দেবো। তার আগে ঘরে চলো। এই যে তুমি ফিরে এসেছো, বৃষ্টি ফিরে এসেছে— এমন আনন্দঘন দিন আমাদের জীবনে কবারই এসেছে, বলো।
আমাদের দিন তো যায় যায়, বর্ষা! দ্যাখো তো! আমাদের দিনগুলো এখন কোনোভাবে কেটে গেলেই হলো। এখন তো জীবনকে উপভোগ করবার পালা বৃষ্টির, ওর বয়সী ছেলেপেলের। বৃষ্টির বন্ধুরা আনন্দে কতোটুকু টগবগ করছে, দেখেছো? ওর পাতাসখিরা ক্যামোন সবুজ শাড়িতে নিজেদের জড়িয়ে নিয়েছে, ওর ফুলসখিরা হেলে দুলে জানাছে স্বাগত। আর পাখিরা ক্যামোন কিচিরমিচির করে ওকে গান শুনিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। কচুরিপানারা মাথায় ঝলমলে ঊষ্ণীষ পরে, দলবেঁধে নৌবহর সাজিয়ে নিয়ে আসছে আমাদের বৃষ্টির আগমনে। শুধু ঘুঘুটা সকাল থেকে ক্যানো য্যানো একটানা, বিরামহীন বিলাপ করে চলেছে।
থাক্ থাক্! আর কিচ্ছুটি বলতে হবে না তোমায়। আগে ঘরে চলো। তোমার সব কথা শুনবো আমি। শুধু একটা অনুরোধ রাখি, বর্ষা। অকারণ ভুল বুঝে, এভাবে হুটহাট চলে যেয়োনা কোনোদিন।। হোক সেটা অভিমান কিংবা কৃতকর্মের জন্য। চলো আমাদের কন্যা বর্ষা ঘরে বসে অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছে। আমাদের সংসার আবার ভরে উঠুক ফুলে ও ফসলে, কলকাকলিতে। মরুময়-প্রখরতা আমাদের বুকে য্যানো আর আবাস গড়তে না পারে। এটুকুই চাই।
ছন্নছাড়া